❮ Back (click to back)
ছাতকে যে ভাবে মাইক্রো-ক্রেডিট শুরু হলো
Saturday, March 14, 2015 18:15:56
Written by : Zakaria Dawn
0
(0 Rated out of 2,293 Read)

০১...আমি যখন এনজিও প্রোগ্রাম এ কাজ করতে ব্রাক থেকে ছাতকে পৌছলাম, তখনো কোন এনজিও সেখানে কাজ শুরু করতে পারেনি। গ্রামীন ব্যাংক ঝুঁকি মুক্ত এলাকা বুঝে কোথাও কোথাও গরীব মহিলাদের নিয়ে সমিতির কাজ করে যাচ্ছিলো। এই সময় বিশ্বনাথ থানা থেকে ব্রাকের অফিস তুলেদিতে বাধ্য করেছিলো এলাকাবাসী অথবা গ্রামের পঞ্চায়িত।শুনেছিলাম ঢিলমেরে তুলে দেয়া হয়েছিলো তাদের। অফিসটা ফেঞ্চুগঞ্জে চলেগিয়েছিল।মৌলবাদী প্রভাব ছিলো ভয়ঙ্কর।ছাতকেও।এলাকাবাসীরা গর্ব করে বলতেন, “ইতা ৩৬০ পীর আউলিয়ার দেশ”.....কোথাও কোথাও নির্জন টিলার উপরেও দেখতাম কোন পীরের পাকা কবর, জিয়ারত করে যেতেন অনেকে। গ্রামের পথ ধরে যখন চলতাম, ভিনদেশী বুঝে গ্রামের মেয়ে-বৌ-রা পথ থেকে শস্য খেতে নেমে যেতো, আমি চলে না যাওয়া পর্যন্ত ঘোমটা টেনে বিপরীত দিকে মুখ করে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতো তারা।সব কিছু দেখে-বুঝে ভয়-ভীতি আর অজানা আশঙ্কা নিয়ে বিছানায় ঘুমাতে যেতাম, কি করে এখানে আমি প্রোগ্রাম করতে পারবো?? কিন্তু তখনো বুঝিনি....সব বাধা পেরিয়ে একসময় সম্পুর্ন থানার গরীব মানুষদের কাছে খুব জনপ্রিয় আর শ্রদ্ধার মানুষ হয়ে উঠবো।
টেনশন কাজ করতো। ভয় আঁচর দিয়ে যেতো মাঝে মাঝে। সেই সাথে কষ্ট আর পরিশ্রম।মৌলবাদী পরিবেশ কুয়াশার মতো ছাতককে ডুবিয়ে রেখেছিলো। এর মধ্যে দিয়ে কাজ করে টার্গেট বা গরিব পরিবারকে আয়ত্তে আনা, অন্য দিকে অধীনস্তদের শুকনো মুখে ফুল ফোটানোর অবিরত অপ্রচেষ্টা আমার।
সুরমার ওপারে কুঁচবাড়ি গ্রামে আমার এক অধীনস্তকে শুধু হুমকিই দেয়া হলো না, যে সমস্ত পরিবারকে সংগঠিত করা হয়েছিলো--তাদের ভিতর ত্রাস সৃষ্টি করা হলো।গাঁয়ের পঞ্চায়িতে আমার ব্রাক অফিসের বিরুদ্ধে জনমত তৈরীর সূচনা হলো।ভয়ে চোখমুখ শুকিয়ে উঠলো সবার।মোস্তফা, ক্রমেই যে আমার ডান হাত হয়ে উঠছিলো, বললো, “ ভাই, আমি এই একটা গ্রামের পরিবর্তে আরো দশটা সংগঠন তৈরী করবো, আপনি এই গ্রাম ছাড়েন।”
“মোস্তফা, মানুষের মধ্যে ভুল ধারনা পয়জন সৃষ্টি করে। আমি কোথাও পয়জন রাখতে চাই না। আমি এই শুক্রবারে পঞ্চায়িতের মসজিদে নামাজ আদায় করতে যাবো সবার কাছে উত্তর চাইবো, আমার কাজ খরাপ না ভালো! উনাদের অন্তর থেকে আমি ভালোটাই আনতে পারবো।
“কিন্তু....ভাই....!!!
“আপনারা ভয় পেলে যাবার দরকার নেই, আমি একাই যাবো। একটা কথা মনে রাখবেন, আমরা এখানে রাজনৈতিক তৎপরতা নিয়ে আসিনি, আসিনি দেশ দখল করতে, অন্যকে ধর্মান্তরিত করে ধর্ম-প্রচার করতে, এসেছি গরীব পরিবারদের স্বাবলম্বী করে তুলতে, আর এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে যেখানে পরিবারের পুরুষরাই তাদের নারীদের পাশে থেকে তাদের ভারসাম্যে নেবে, প্রকৃত অধিকার আর ক্ষমতায়নে সহায়তা করবে।তাদের জানাতে হবে..এযুদ্ধ তাদের পুরুষ আর ধর্মের বিরুদ্ধে না বরং দারিদ্রতার বিরুদ্ধে, নিজেদের উন্নয়নের পথে।
আমি জানি আমাদের সম্পর্কে তাদের অস্বচ্ছতার কারনেই মৌলবাদী আক্রমনের শিকার হতে যাচ্ছি। মানুষের মনে আল্লাহ তো ভালো-মন্দ বোঝার অনেক সুক্ষ জ্ঞান দিয়েছেন মোস্তফা... আর যখন বুঝবে খারাপ কিছুই হচ্ছে না বরং ভালোটার সুবাস পাবে তখন তাদের ভিতরে বিরুদ্ধ শক্তিটা আর থাকবে না। সেই পর্যন্ত কিছুটা ঝড়-ঝাপটা আসবে। আর সেটাকে জয় করতে দরকার একটু সাহস, একটু ধৈর্য, মানুষের প্রতি আন্তরিকতা আর ভালোবাসা, দরকার হিসাবি কথাবার্তা আর দক্ষ প্রেষনা........আমি দেখতে পাচ্ছি মোস্তফা, আমাদের অফিস মানুষের ভালোবাসা দিয়ে ভরে উঠছে........



০২...সুরমা নদীর তীর।লক্ষীবাউর জেলে গ্রাম।লোক পাঠানোর আগে প্রতিটি এলাকা আমি নিজে আগে ভিজিট করি। সেই এক শীতের ভোর সকালে মাদ্রাসায় পড়ে এমন দুজন যুবকের সকল র্ভৎসনা, ভয়-ভীতি প্রদর্শনকে উপেক্ষা করে স্মিত হাস্যে তাদের সম্মুখে এসে দাঁড়ালাম, বললাম. “ আমি মুসলমান, আমার নাম মোঃ আবু জাকারিয়া খান, আমিও পড়ি লা ইলাহা ইল্লেলাহু! আমার ঘরে কোরআনশরীফ আছেঃ, আমিও নামাজ পড়ি। আমাদের রাসুল (সঃ) এর কাছে যদি কোন কাফেরও কথা বলতে আসতে চাইতেন, যতদুর জেনেছি, তিনি মনযোগ দিয়ে তার কথা শুনতেন।”

অতঃপর যুবক দুটি আমাকে নদীর ধারে এক সুবিশাল চাতালের ভিতর নিয়ে গেল। সেখানেক দেখতে পেলাম প্রায় ১০০-১৫০ জন মুসল্লি সহ ভক্ত মানুষজন বসে, একটা উঁচু মাচার উপর বসে আছেন নুরানী চেহারার ৫০/৫৫ বছর বয়সী আলেম, যুবক ২জন আমাকে নিয়ে তাঁর সামনে দাঁড় করালো, বললো, “ হুজুর এই ইনি খৃষ্টান প্রতিষ্ঠানের লোক, গ্রাম গ্রাম ঘুরিয়া গ্রামের বৌ-বেটিনদের ঘরের মধ্যে নিয়া, ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া কি-তা যে করে!!”

আমার শিড়দাঁড় দিয়ে শীতল নেমে গেলো।যা বলা হলো সব মিথ্যে, ছেলে দুটোরই বা দোষ কিসের, তারা তো কিছু না বুঝে বলছে, এই কথা গুলি মুখোরোচক উৎস থেকে বুদ্ব বুদ্ব-এর মতো উড়ে মানুষের মুখ থেকে মুখে ঘুরে বেড়ায়, রঙ বদলায়, আরেক রং ধারন করে। ধার্মিক মানুষদের মাথা গড়ম করে তোলে। শুরু হয় ভুল বোঝাবুঝি, কাদা ছোড়াছুড়ি।

কিন্তু যা বলা হলো তা উপস্থিত ১৫০ জনের গভীরে প্রবেশ করেছে, আর আমার দায়িত্ব হলো....মুখে মুখে এই কাল্পনিক মিথ্যাকে সবার ভিতর থেকে উপড়ে ফেলে সেখানে যেটাই সত্য, সেটা সুপ্রতিষ্ঠিত করা।আঘাত করে কথা বলতে গেলেই তারা আমার প্রতিষ্ঠানের সত্য সম্পর্কে জানবে না, তারা আমাকে কেটে সুরমা নদীতে ভাসিয়ে দিলেও কারো কিছু করার থাকবে না।আলেম আমার দিকে স্থির চোখে তাকালেন, বললেন, ‘ কি-তা রে বা, ইতা কি--তা শুনি..!! চারিদিকের মানুষগুলির চোখে কি ধীরে ধীরে আমার প্রতি ঘৃনার উদ্রেক হচ্ছে...?? আমি মনে মনে আল্লাকে স্মরন করলাম, বললাম হে খোদা তাঁদের কাছে এই প্রতিষ্ঠানের সত্যটা পৌছেনি, আমাকে মনোবল দাও!!

আমি হুজুরের কথায় দৃঢ় ও বিনীত ভাবে অসম্মানিত মিথ্যাকে অত্যন্ত লজ্জিত করে তুলে বলতে শুরু করলাম. ‘হুজুর, আপনার গ্রামের মানুষগুলি অত্যন্ত ভালো, ভদ্র এবং ধর্মপরায়ন, বলুন আপনি, তারা কি এতোটাই পঁচে গেছে যে গ্রামের বৌ-বেটিনদের সাথে ও ভাবে থাকবো আর তাদের বাবা, ভাই, স্বামীরা তা মেনে নেবে, তাদের বাবা স্বামীরা তো এতোটা নীচে নেমে যায়নি হুজুর!!!
বুঝতে পারলাম....কথাটা পত্রিক্রিয়া করছে সবার ভিকরে, এর কি জবাব দিবে, তাদের মাথা কাজ করছে না। হুজুর আমার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘ তাহলে তোমরা গ্রামের মেয়েদের নিয় সমিতি করো ক্যান..?’




Click on stars for reating this article.
  • 0.5
  • 1.0
  • 1.5
  • 2.0
  • 2.5
  • 3.0
  • 3.5
  • 4.0
  • 4.5
  • 5.0
not rated
edit